শেফালীর জীবনের এক কল্প কাহিনী

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী (নভেম্বর ২০১৭)

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত রেলওয়ে স্টেশন -- " বানারতুলি " ।

রাতের শেষ প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি অনেক আগেই চলে গেছে । এমনিতে এই স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা খুবই কম । স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম চত্বরে যে দু-একটি দোকান-পাট আছে , শেষ ট্রেনটি চলে যাবার পর সেগুলির সব ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে । এরপরে হয়ত দু-একটা মালগাড়ী বিকট শব্দ করে যাতায়াত করবে ।

কয়েকদিন ধরে প্রচন্ড গরমে মানুষের জীবন একেবারে ওষ্ঠাগত । তারউপর বৃষ্টির কোন দেখাই নেই । স্টেশনের ওভারব্রিজের তলায় চার ঘর পরিবারের মতন শেফালী আর তার মা খুব ছোট এক ফালি জায়গা দখল করে , ছেঁড়া বস্তা , চট দিয়ে ঘিরে কোনরকমে বসবাস করে । শেফালীর জন্মের পরেই তার বাবা তাদেরকে ফেলে রেখে অন্য একটা বিধবা মহিলাকে বিয়ে করে ভেগে পরে । মা বাড়ী-বাড়ী ঝি-এর কাজ করে দুজনের খুব কষ্টে পেট চালায় ।

শেফালীর মার শুধু একটাই চিন্তা যখন সে আর ইহ জগতে থাকবে না , তখন তার এই ভীষন ভাবে বিকলাঙ্গ মেয়েটার কি হবে ? কে তাকে দেখবে ? শেফালী জন্মাবার পর থেকেই তার হাত-পা সব কোঁকড়ানো । হাঁটতে পারে না , হাত দিয়ে খেতে পারে না আর ভাল করে শুতেও পারে না । একটা মাংসের দলার মতন শরীরটা । একটাই তার সুন্দর জিনিস সেটা হচ্ছে তার মুখখানা । একেবারে দুর্গা প্রতিমার মতন । সেটাও বোধহয় ভগবান সইলেন না । ভাগ্যের এমনই পরিহাস হটাৎ একদিন রান্নার জ্বলন্ত উনুনে তার সুন্দর মুখখানা ভীষণ ভাবে পুড়ে গিয়ে চেহারাটা আরো কুৎসিত আকার ধারণ করলো । স্টেশনের পাশেই বিরাট একটা মাঠ । মাঠের চারিদিকে জনবসতি একটু কম । শেফালীর সারা শরীর জুড়ে জ্বালা তারউপরে অস্বাভাবিক গরমে এই ছোট্ট গুমোট ঝুপরিতে টিকতে না পেরে , মাকে বললো -- আমাকে একটু খোলা মাঠটায় বসিয়ে দিয়ে আসবে মা ? আমি খোলা মাঠটায় বসে একটু প্রান ভরে নিশ্বাস নিই । সারাদিনের খাটা-খাটনির পর শেফালীর মা মেয়েকে
পাঁজাকোলা করে খোলা মাঠটায় বসিয়ে দিয়ে আদর করে বললো -- তুই এই খোলা জায়গায় বসে বাতাস নে , আমি কিছু সময় পরে এসে তোকে নিয়ে যাব ।

বিরাট ফাঁকা মাঠটায় একপাশে সবুজ ঘাসের উপর বসে আর অল্প অল্প হাওয়া গায়ে লাগতে বেশ ভালোই লাগছিল । রাত এখন অনেক । চারিদিক নিস্তব্ধ । আশেপাশের সবাই গভীর ঘুমে আছন্ন । জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমে চোখটা বুজে আসছিল । হঠাৎ আকাশে একটু সময়ের জন্য এক আলোর ঝলকানি দেখে চোখের থেকে ঘুমের ভাবটা চলে গিয়ে দেখলো -- ছোট একটা অদ্ভুত রকমের দেখতে যান নিঃশব্দে মাঠের মাঝখানে এসে নামলো । কিছুক্ষন পর সেই যানটার থেকে দু-জন দেরফুট মাপের মানুষ গোত্রীয় লোক বেরিয়ে এলো । অদ্ভুত ধরনের পোশাকে সজ্জিত লোক দুটি জামার পকেট থেকে একটা তারের জালের মত জিনিস বার করে কিছু একটা করতেই যে যানটা মাঠে নেমেছিল , সেটি নিমেষের মধ্যে আকাশে মিলিয়ে গেল ।

অদ্ভুত ধরনের দেখতে লোকগুলির মাথা দেহ আন্দাজে অনেক বড় । মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে তারা শেফালীকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো । যেহেতু শেফালীর দৌড়ে পালিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই , সে লোকদুটিকে তার কাছে আসতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করলো । অদ্ভুত ধরনের লোকদুটি তার সামনে এসে আকার-ইঙ্গিতে বললো -- তুমি কান্নাকাটি করো না । আমরা তোমার বা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে আসিনি । তোমরা যেমন এই পৃথিবীর গ্রহতে থাক , আমরাও থাকি অন্য আর এক গ্রহে । তোমাদের পৃথিবী থেকে কয়েক লক্ষ কোটি মাইল দূরে আমাদের গ্রহ । আমাদের গ্রহতে বসেই আমরা গবেষণা করে জানতে পেরেছি পৃথিবী ছাড়া আর কোন কোন গ্রহে প্রানের স্পন্দন রয়েছে । গবেষণার মাধ্যমে এও জানতে পেরেছি যে গ্রহতে প্রানের স্পন্দন আছে তারা শুধু নিজেদের গ্রহতেই অবস্থান করছে , অন্য গ্রহতে যেতেও পারেনি আর যাবার চেষ্টাও করে নি । একমাত্র তোমাদের গ্রহ থেকেই অন্য গ্রহে অর্থাৎ চাঁদে গিয়েছে তোমাদের পৃথিবীর মানুষ । আমরা অবশ্য বিভিন্ন গ্রহের সঙ্গে চাঁদেও বহুবার গিয়েছি । যেহেতু একমাত্র তোমাদের পৃথিবীর লোক অন্য গ্রহতে পদার্পন করেছে , তাই আমাদের ইচ্ছে হলো তোমাদের গ্রহতে এসে তোমাদেরকে নিয়ে গবেষণা করবার ।

তোমাদের এখানে আমরা চারটি জায়গাকে বেছে নিয়েছি আমাদের গবেষণা করবার জন্য । এক -- যে জায়গা থেকে তোমাদের পৃথিবীর লোক চাঁদে গিয়েছিল । দুই -- তুষার আবৃত কোন পাহাড়ের চূড়ায় । তিন -- দিগন্তহীন কোন উত্তাল মহাসাগরের নিচে । চার -- কোন কম জনবহুল এলাকার খোলা মাঠে , পৃথিবীর মানুষদের সুখ দুঃখের জীবন নিয়ে গবেষণা করবার জন্য । পৃথিবীর অন্য জায়গাগুলির গবেষণার কাজ আমাদের হয়ে গেছে । বাকি আছে শুধু পৃথিবীর মানুষদের নিয়ে গবেষণার কাজ । এই গবেষণার জন্য আমাদের দুদিন সময় লাগবে তারপর আমরা আমাদের নিজেদের গ্রহে ফিরে যাব । আমরা নিজেদের গ্রহতে বসে গবেষণার মাধ্যমে তোমাদের পৃথিবীর লোকেদের ছবি দেখেছি , কিন্তু তোমার চেহারা এই রকম কেন ??

শেফালী একটু ধাতস্ত হয়ে আর নিজের মনের জোর সঞ্চয় করে তার জীবনের প্রথম থেকে শেষ অবধি সব কথাই খুলে বললো । শেফালীর কথাগুলি লোকদুটি মনযোগ সহকারে সব শুনছিল আর পকেট থেকে তারের জালগুলি বের করে কি সমস্ত করে যাচ্ছিল । নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনা করে শেফালীকে বললো -- তুমি কালকে ঠিক এই সময় এই জায়গায় চলে আসবে । তুমিই আমাদের কাছে দেখা প্রথম পৃথিবীর মানুষ যার চেহারাটি তোমাদের পৃথিবীর অন্য মানুষদের থেকে একেবারে অন্যরকম । তোমাকে নিয়ে আমরা আমাদের গ্রহের চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে কিছু গবেষণার কাজ করবো । আজকের এই ঘটনাটা তুমি আপাতত কাউকে বলবে না । তুমি একাই আসবে । এই বলে তারের জালে কিছু একটা করতেই তাদের যানটি আবার ফিরে এসে তাদের দুজনকে নিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল ।

শেফালী পরের দিন গভীর রাতে মাঠের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় লোক দুটোর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে । একটা সময় লোকদুটি তাদের যান থেকে নেমে শেফালীর কাছে এসে বললো -- আমাদের পৃথিবীর উপর গবেষণার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে , আমরা একটু পরেই তোমাদের পৃথিবী ছেড়ে আমাদের নিজেদের গ্রহে ফিরে যাব । পৃথিবীর মানুষ হিসেবে তোমাকে নিয়ে আমরা গবেষণা করেছি মনে হয় সুফলও পেয়েছি । এই বলে লাল রঙের ত্রিভুজ আকারের একটা ছোট পাথর শেফালীর হাতে দিয়ে বললো -- আমরা চলে যাবার পর তুমি এটা খেয়ে নিও । তারপরই তারের জালগুলি বের করে নানা রকমের সংকেত করতেই আকাশ থেকে তাদের গ্রহে ফিরে যাবার জন্য যানটা নেমে এলো । দুজন যানটাতে উঠতেই একটা আলোর ঝলকানি দিয়ে দূরের আকাশে নিঃশব্দে নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গেল ।

অদ্ভুত লোকদুটি চলে যাবার পর শেফালী কৌতূহল বশত তাদের দেয়া লাল রঙের ছোট পাথরটি মুখে দিতেই অমনি পেটের ভিতরে ঢুকে গেল । মুহুর্তের মধ্যে শেফালীর সারা শরীরে একটা অদ্ভুত ধরনের অজানা অনুভূতি জেগে উঠলো । অনায়াসে দুপায়ে দাঁড়িয়ে সহজেই হাঁটতে হাঁটতে তাদের রেলের ওভারব্রিজের তলার ঝুপড়ির ঘরে এসে ঢুকলো ।

শেফালীর মা নিজের মেয়েকে একেবারেই চিনতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো -- তুমি কে মা ? এত সুন্দরী তুমি !! আমার এই ঝুপড়ির ঘরে ? তুমি এখানে কেন মা ?

সুন্দর মুখশ্রী নিয়ে শেফালী যত তার মাকে বোঝাচ্ছে যে সে " শেফালী " , তারই মেয়ে , শেফালীর মা ততই অবাক হচ্ছে । অবশেষে শেফালী তার মাকে পুরো ঘটনাটা বলার পর পরম আনন্দে চোখে জল নিয়ে শেফালীকে জড়িয়ে ধরলো । শেফালীও তার মাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললো -- আজ আর একেবারেই কান্না নয় , আজ শুধুই আনন্দ , আজ শুধুই হাসি ।

শেফালীর মা ঘুম চোখে বললো -- কি হয়েছে তোর ? তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে এত হাসছিস কেন ? সম্বিত ফিরে শেফালী ভাবতে থাকল অন্য গ্রহের লোকেদের মতন আমাদের পৃথিবীর মানুষ ও যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর গবেষণার মাধ্যমে সফল হয়ে সমস্ত ধরনের কঠিন রোগ , ব্যাধি , বিকলাঙ্গতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারত , তবে আমাদের পৃথিবীর মানুষদের কতই না উপকার হোত ......।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া পুরোনো গল্প। পড়তে ভাল লাগল। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে... বেশ অভিনব কল্পনাশক্তি আপনার। সময় পেলে আসবেন একবার আমার পাতায়। এ সংখ্যায় আপনার কোন লেখা পাইনি। আশা করি আগামী সংখ্যায় পাব। ভালো থাকবেন।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী গল্পের সাবলিলতা বেশ ভালো লেগেছে, আর বর্ননা তো একেবারে কড়াকড়ি। ভিন্ন গ্রহ থেকে পৃথিবী নামক গ্রহ আবিষ্কার, সে গ্রহ থেকে পৃথিবী নামক গ্রহে তাকে ওষুধ এনে দিয়ে তার করুণ অবস্থা সম্প্রসারণ করা.... খুব অসাধারণ লাগলো। তবে এক জায়গা দিয়ে কেমন যেন লেগেছিল- যেমন, আপনি বলেছেন তার গায়ে কোন শক্তি নেই; যখন ভিন্ন গ্রহের লোকেরা তাকে পরদিন আসতো বলল এবং আপাততে কাউকে তাদের কথা বলতে না করলো, তাহলে প্রশ্ন আসে পরেরদিন সে (গল্পের নায়িকা) কিভাবে একই জায়গা অবস্থান করলো?
ভাই , ধন্যবাদ , গল্পটা পড়ে মূল্যবান মতামত দেবার জন্য । .... গল্পের নায়িকা পরের দিন একই জায়গায় অবস্থান করলো তার মায়ের সাহায্য নিয়ে যেমন ভাবে আগের দিন তার মায়ের সাহায্যে সে সেই জায়গায় গিয়ে বসে ছিল , অবশ্য কৌতূহল বশত পরের দিন সেখানে আসার আসল উদ্দেশ্য গোপন রেখে ।
প্রজ্ঞা মৌসুমী বিজ্ঞানে আগ্রহ থাকলেও, আগ্রহের অভাবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়েছি হাতে গোণা। আমার ভালো-মন্দ বলা অর্বাচীনতাই। গল্পের ইতিবাচকতা (শেফালীকে সুস্থ করে দেয়া) পড়তে ভালো লেগেছে। আরও একটু কল্পনা থাকলে কী ক্ষতি ছিল?- যেমন তারের জালি, দেড়ফুট মানুষ দুটোর, কেমন ছিল লাল রঙা পাথরের স্বাদ- এই বর্ণনাগুলো থাকতে পারতো। আর চাঁদটা গ্রহ নয়, উপগ্রহ।
আপনার মন্তব্য পড়ে ভাল লাগল । ধন্যবাদ । ... আর অসাবধান বশত উপগ্রহের বদলে গ্রহ শব্দটি লেখা হয়ে গেছে ।

১২ আগষ্ট - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৪৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪